ভালবাসা বসন্তে মাতোয়ারা বাঙালী
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওরে আয় রে তবে, মাত্ রে সবে আনন্দে/ আজ নবীন প্রাণের বসন্তে…। নবীন প্রাণের বসন্তকে উৎসব আনন্দে বরণ করে নিল বাঙালী। প্রিয় ঋতুর বর্ণিল বন্দনা হলো দিনভর। একই দিনে ‘হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু’কূল ভেসে’ গেল ভালবাসায়। এমন প্রেমের টানে, প্রাণ প্রকৃতির জোরালো আহ্বানে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন সবাই। করোনাকালের ক্ষত ভুলে নিজেকে নানা রঙে খুঁজে নিলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন। তাকালেন সামনের পানে।
বাঙালী ঐতিহ্যের বলেই ফাল্গুনের স্বতন্ত্র আবেদন। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ প্রতি দুই মাস অন্তর রূপ পরিবর্তন করে। শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। বসন্ত দিয়ে শেষ। শেষ ঋতুটিকে ঋতুরাজ বলে ডাকা হয়। এ ঋতু শুরুর দিনেই রাঙিয়ে দিয়ে গেল। শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে গেল। মনের গহিন কোণে অতি সূক্ষ্ম যে পুলক, বসন্তই জাগাতে পারে, জাগিয়ে দিল। প্রকৃতির প্রতি প্রেম, প্রিয় ঋতুর বন্দনা আর মানুষে মানুষে ভালবাসার জয়গান হলো দিনভর।
পছন্দের ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: নব বসন্তের দানের ডালি/এসেছি তোদেরই দ্বারে/আয় আয় আয়/পরিবি গলার হারে…। বসন্তকে গলার হার করেই যেন শহর ঘুরে বেড়িয়েছে মানুষ। প্রেমের কবি নজরুলের উচ্চারণÑ এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন…। এমন ফালগুনে খুন হওয়ার জন্যই যেন অপেক্ষা করে মানুষ।
এদিন খুব ভোরে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তরুণ-তরুণীরা। মেয়েদের কেউ বাসন্তী রঙের শাড়িতে সেজে বের হয়েছিল। খোঁপায় পেঁচিয়ে নিয়েছিল হলুদ গাঁদার ফুল। ছোট্ট মেয়েটিও শাড়ি গায়ে বড়দের মতো হেঁটে গেছে। কী যে সুন্দর সে দৃশ্য! আবার কেউ কেউ গায়ে জড়িয়েছিল লাল রঙের শাড়ি। ছেলেদের কেউ বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরেছিলেন। কেউবা লাল। ফলে নানা রঙের হয়ে উঠেছিল দিনটি। রাজধানীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল উৎসব। হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলা যুগলরা শহর ঢাকার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।
রাজধানীর একাধিক স্থানে বসন্ত উৎসব ॥ রাজধানীর একাধিক স্থানে এদিন বসন্ত বরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বহু বছরের ধারাবাহিকতায় একসঙ্গে তিন ভেন্যুতে উৎসব আয়োজন করে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষৎ। বসন্তের প্রকৃতি বর্ণনা ও বন্দনা করা ছাড়াও এসব মঞ্চ থেকে বাঙালীর জীবনে বসন্তের প্রভাব নানা ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হয়। এবার চারুকলার বকুলতলার পরিবর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে ছিল মূল আয়োজন। সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে সূচনা করা হয় বসন্ত উৎসবের। প্রথমেই ছিল যন্ত্রসঙ্গীত। প্রিয় সুরে বসন্ত বন্দনা করেন দীপেন সরকার। কবিতার ভাষায় ফাগুনের রং-রূপ বর্ণনা করেন বাচিক শিল্পীরা। এর পর গান আর নাচের ভরপুর আয়োজন। খোলা মঞ্চের চারপাশ ঘিরে দর্শকের বসার স্থান। সেখানে বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতি। মঞ্চের শিল্পীদের সঙ্গে গাইছিলেন তারা। মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছিলেন নাচ। উৎসব জমিয়ে রাখে শিশুরা। নারীরা। ঢাকার দলগুলোর পাশাপাশি সাঁওতালদের একটি দল যোগ দিয়েছিল নাগরিক উৎসবে। মাতিয়ে রেখেছিল। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল আবির বিনিময় ও প্রীতি বন্ধনী। উৎসবে আগতরা একে অন্যকে আবির মেখে দেন। এর আগে সকালে বসন্তকথন পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সংগঠনের সহসভাপতি কাজল দেবনাথের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষৎ-এর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট। বক্তারা মহামারীর কালে প্রকৃতি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নতুন করে শুরুর আহ্বান জানান সবাইকে। এখানে বসন্ত উৎসব চলে সকাল ১০ টা পর্যন্ত।
বসন্ত উৎসব আয়োজন করা হয় গেণ্ডারিয়ার সীমান্ত গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণেও। বাদ যায়নি উত্তরা। উত্তরার আজমপুর প্রাইমারী স্কুল মাঠে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলে উৎসব।
বিকেলে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। নন্দন মঞ্চে বিকেল ৪টায় শুরু হয় উৎসব। বিশেষ পর্বে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাজেদ আকবর-সালমা আকবর ও খাইরুল আনাম শাকিল-কল্পনা আনাম দম্পতি। নাটকের অংশবিশেষ পাঠ করেন শহীদুজ্জামান সেলিম-রোজী সিদ্দিকী দম্পতি ও অনন্ত হীরা- নূনা আফরোজ দম্পতি। এখানেও ঢাকার পাশাপাশি পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের শিল্পীরা অংশ নেন।
তবে প্রতিবছর বসন্ত উৎসবের বড় ঢেউটি আছড়ে পড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় পুরোটাজুড়ে মেলা আয়োজন করা হয়। এর পরও ফাগুন ও ভালবসার দিনে তিল ধারণের জায়গা থাকে না মেলা প্রাঙ্গণে। অগনিত মানুষের উপস্থিতি, বই কেনা, উপহার দেয়া, হাসি গল্প, ছবি তোলা- আরও কত কী! বইয়ের সঙ্গে ভালবাসার গোলাপও বিনিময় হয়। কিন্তু এবার এসবের কিছুই হয়নি। কারণ, বইমেলা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মেলা চলে গেছে মার্চে। এ কারণে গোলাপ হাতে বইমেলা ঘুরে বেড়ানোটা এবার আর হয়নি।
ভালবাসার যুগল স্রোত ॥ সারা পৃথবীর মতো বাংলাদেশেও এদিন উদ্যাপিত হয় ভ্যালেনটাইনস ডে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি হলেও, এ দেশে দিবসটি বেশ জনিপ্রিয়। প্রেমিক পুরুষ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের হাত ধরে পাওয়া। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, প্রেমিক প্রেমিকারা এদিন একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে চলে ভালবাসার আদান-প্রদান। প্রেমিকের হাত হয়ে প্রেমিকার সুবিন্যস্ত খোঁপায় ওঠে লাল গোলাপ। কবিগুরু বলেছিলেন, তোমার গোপন কথাটি, সখী রেখো না মনে।/শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে…। হৃদয়ের একান্ত গোপন কথা প্রকাশ করতেও বিশেষ এ দিবসটিকে বেছে নেয়া হয়।